কক্সবাংলা সম্পাদকীয়(১২ ডিসেম্বর) :: কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে দিন দিন অপরাধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই অপরাধের প্রবণতা ও সহিংসতা কমছেই না বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।
আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা ও আরএসও’র মধ্যে গোলাগুলিতে উখিয়ার তিন আশ্রয়শিবিরের ৪ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ১৫ দিনে নিহত হলেন ৯ জন।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ৮ মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে ৬১টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৭৪ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। বস্তুত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলো সন্ত্রাসীদের এক ধরনের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, মাদকের কারবার, দোকানপাট, ব্যবসা–বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পের ভেতরে–বাইরে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এতে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রায়ই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে।
রোহিঙ্গারা নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে। তাদের নানা অপরাধের কথা তুলে ধরে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, গত ৫ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৮টি।
উক্ত মামলায় আসামির সংখ্যা ৫ হাজার ২২৬ জন। মামলাগুলোর মধ্যে অস্ত্র মামলা ১৮৫টি, মাদক মামলা ১ হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ ৮৮টি, হত্যা ১১৫টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩৯টি। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৩৫ হাজার নতুন শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই নতুন শিশুর জন্মের কারণে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বছর বছর বেড়ে চলেছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি মাদক, মানব ও অস্ত্র পাচারের কারণে নানা ধরনের নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করছে। এ সমস্যা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেনি, তবে এটা ক্রমেই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না।
এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ক্রমশই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সমস্যার তালিকা। আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের খাদ্য ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানে জটিলতা বাড়ছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যত কী হবে তার কোনো সুরাহা হয়নি। এখনো কোনো স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুটি এভাবেই পড়ে থাকছে অমীমাংসিত ইস্যু হয়ে। যেখানে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার কথা, সেখানে তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচর থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের উপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার চাপ আন্তর্জাতিকভাবে অব্যাহত রাখতে হবে।
বলা অত্যাবশ্যক যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের জন্যও হুমকি। রোহিঙ্গাদের যদি দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া না হয় এ সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে।
অভিযোগ আছে, বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ ঝুঁকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার রক্ষা ও বাংলাদেশের পরিবেশগত দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন জরুরি।
তাঁরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে যে মানবিকতা ও বদান্যতা দেখিয়েছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে একটি উদাহরণ। আয়তনে ক্ষুদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজারে আশ্রয় দেন প্রধানমন্ত্রী।
এর পর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সহায়তায় তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সরকার নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু তাদের প্রত্যাবাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও পরবর্তী সময়ে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক, সেটা চায় না সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। তাই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়ে যায় সন্ত্রাসী তৎপরতা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যাতে বাস্তবায়িত না হয়, সেজন্য বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝি বা নেতাদের টার্গেট করছে আক্রমণকারীরা। তাই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। যেভাবেই হোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে।
Posted ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta